ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভয়াল ২৯ এপ্রিল ! লন্ডভন্ড চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল ….৩৩ বছরেও থামেনি স্বজন হারাদের কান্না

 বাঁঁশখালী , চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর দিন। ১৯৯১ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিহত এবং ক্ষতি হয় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ, ফলে প্রায় এক লক্ষ মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১ কোটি মানুষ। ৩৩ কিলোমিটার বেড়ীবাঁধে ২৬ স্থানে ফাটল, আতংকে বাঁশখালী উপকূলবাসী। দীর্ঘ , দুঃসহ সেই স্মৃতি এখনো তাড়া করে উপকুল বাসীকে, ৩৩ বছরেও থামেনি স্বজন হারাদের কান্না।

 

 

নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ৯১-এর এই ঘূর্ণিঝড় একটি। উপকূলবাসীকে এখনো সেই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দুঃস্বপ্নের মতো ‍তাড়িয়ে বেড়ায়।ঘটনার এত বছর পরও স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না সেই দুঃসহ দিনটি। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় জলোচ্ছ্বাস আর ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে হলে। নিহতদের লাশ, স্বজন হারানোদের আর্তচিৎকার আর বিলাপ বার বার ফিরে আসে তাদের জীবনে। ঘূর্ণিঝড়টি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। ফুঁসে ওটা সমুদ্রের ২৫ ফুট উঁচু তীব্র জলোচ্ছ্বাসের তেড়ে ভেসে গিয়েছিল বিস্তীর্ণ উপকূলীয় বাঁঁশখালী,আনোয়েরা, সন্ধীপ সহ কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও চকরিয়া উপজেলায়। সর্বোচ্ছ ২২০ কিলোমিটার গতিবেগে বয়ে যাওয়া ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে বিরান ভূমিতে পরিনত হয় উপকূল। এর সাথে মারাত্বক জলোচ্ছাস লন্ডভন্ড করে দেয় বাঁশখালী উপজেলা সহ বাংলাদেশের দক্ষিণ -পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা। হাজার হাজার মানুষ সহ ৭৫-৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি, অসংখ্যা গবাদি পশু ও গাছ-পালা ধ্বংস হয়। গাছের ডালে, ঘরের চালে, খাল-বিলে, নদীতে ও সাগরে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। ঘরবাড়ী বিধ্বস্ত হয়ে প্রচুর ধনসম্পদ ভেসে যায়। ঘূর্ণিঝড়ে দেশের সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকা বাঁশখালী। শুধু বাঁশখালীতেই সেদিন ৪৫ হাজার মানুষ নিহত এবং কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ধবংসস্তুপে পরিণত হয়। সেদিন এদেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে অবলোকন করেছে প্রকৃতির অমানবিক তান্ডব। সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি উপকূলীয় বাঁঁশখালী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের মানুষের। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই রুদ্ধশ্বাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ আর কখনো হয়নি। সেই দিনের স্বজন হারানোর ব্যাথা বুকে নিয়ে প্রতিনিয়ত বেঁছে আছে উপকূলের মানুষ।

ফাইল ছবি ২৯ এপ্রিল ১৯৯১

প্রায় ৩৮ কিলোমিটার সাগরবেষ্টিত বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকা একটি মাত্র বেড়িবাঁধের অভাবে আজও অরক্ষিত। অবশ্য বর্তমান সরকার উপকূলবাসীকে রক্ষার্থে ২৫১ কোটি টাকার বিশাল বরাদ্দ দিয়ে উপকূলীয় বেড়িবাঁধকে আধুনিক বেড়িবাঁধে পরিণত করার কার্যক্রম হাতে নিলেও ঠিকাদারদের নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে খুবই ধীর গতিতে চলছে উন্নয়ন কাজ। উপকূলীয় জনগণের অভিযোগ বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে যথেষ্ট অনিয়ম পরিলক্ষিত হলেও স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেন কোন মাথাব্যাথা নেই। অথচ উপকূলবাসীর জীবন-মরণ বাঁধ খ্যাত এ বেড়িবাধটি অরক্ষিত থাকায় বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী ৫ লক্ষাধিক মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। উপকূলীয় ছনুয়া, বড়ঘোনা, গন্ডামারা, সরল, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, ইলশা,পুকুরিয়া,সাধনপুর ও প্রেমাশিয়াসহ বাঁশখালীর ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ প্রতি বর্ষায় আরো একটি ২৯ এপ্রিলের ছোবল আতঙ্কে থাকেন। প্রতিবছর এই দিনে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে উপকূলবাসীর মাঝে। বিশেষ করে খানখানাবাদ, কদমরসুল, ছনুয়া, বড়ঘোনা, গন্ডামারা ও প্রেমাশিয়া এলাকায় প্রতি বর্ষায় সামুদ্রিক লবণ পানি প্রবেশ করে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ঘরবাড়ী বিধ্বস্ত হয়। এই সময় হাজার হাজার মানুষকে পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনাযাপন করতে হয়।

 

 

এখন উপকূলীয়বাসীর একটাই দাবী এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ, ব্রীজ ও কালভার্ট নির্মাণ, সাইক্লোন সেল্টার ও আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন, বর্তমানে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা সাইক্লোন সেল্টার গুলো দখলমুক্ত করণ এবং উপকূলীয় এলাকার রাস্তাঘাটের সংস্কারের মাধ্যমে বাঁশখালী উপকূলীয় জনগণের চাহিদা পূরণে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বাঁশখালী উপকূলবাসীর জীবন রক্ষায় ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার নব নির্মিত স্থায়ী বেড়িবাঁধ জলোচ্ছ্বাস ছাড়াই ভাঙছে আর ভাঙছে। খানখানাবাদ উপকূলের কদম রসুল গ্রামে বেড়িবাঁধ জোয়ার-ভাটার স্রোতে প্রতিদিনই ভাংগনের খেলায় এখন বিশালকার রূপ নিচ্ছে। কোথাও আবার বাঁধ ধসে গেছে ভয়ানকভাবে। একই দৃশ্য খানখানাবাদের প্রেমাশিয়া, খানখানাবাদ গ্রাম, পুকুরিয়ার তেইচ্ছিপাড়া, সাধনপুরের রাতা খোর্দ, গন্ডামারার বড়ঘোনায়, শেখেরখীলের ফাঁড়ি মূখের অদূরে, ছনুয়ার ছোট ছনুয়া। উল্লেখিত স্থানগুলোর অন্তত ২৬ স্থানে নব নির্মিত বেড়িবাঁধে সিসি ব্লকে ধ্বস দেখা দিয়েছে। নিম্নমানের সামগ্রীতে নির্মিত সিসি ব্লকের সিমেন্ট উঠে গিয়ে সিসি ব্লক ভেঙে গেছে। স্থানীয়রা অভিযোগ তুলেছেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের নামে লুটপাটের কারণে অল্প সময়ে স্থায়ী বেড়িবাঁধে ফাটল ধরেছে এবং ভাঙছে। যার ফলে কোটি টাকার বেড়ীবাঁধ এখনো অধরা, স্বপ্নের মতোই।

 

এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, ২০১৫ সালে বাঁশখালীতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হলে কাজ শেষ হয় ২০২২ সালে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে দুর্নীতি করেছেন এ বাঁধ নির্মাণে। বেড়িবাঁধ রক্ষায় ঢালু বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত ঘাস ও গাছ লাগানোর কথা থাকলেও তা লাগানো হয়নি। ব্লক নির্মাণে নিম্নমানে পাথর, ইট, সিমেন্ট ও বালু ব্যবহার করায় কাজ বুঝিয়ে দেয়ার আগেই অধিকাংশ সিসি ব্লক ভেঙে গেছে। বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধ জুড়ে ভাঙা সিসি ব্লক দৃশ্যমান ও নিম্নমানের বেড়িবাঁধ দৃশ্যমান হলেও পাউবো’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোন নজর নেই।

 

ছনুয়া এলাকার বাসিন্দা আমিরুল কবির ইমরুল বলেন, তখন আমরা স্কুলে পড়তাম। আমি থাকতাম চট্টগ্রামে। ঘূর্ণিঝড়ে খবর পেয়ে পরের দিন যখন বাড়িতে যাই ঝড়ের তাণ্ডব তখন ছিল না। কিন্তু সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। মৃত গবাদি পশু যেখানে সেখানে পড়ে ছিল। গাছের উপরে লটকে ছিল বাড়ির চালা। এই ঝড় এতো প্রলয়ঙ্করী ছিল যে, বাতাসের তোড় গায়ের জামা পর্যন্ত খসিয়ে নিয়েছিল।

 

গন্ডামারা এলাকার সরওয়ার আলম সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন লাশের স্তূপ জমে গিয়েছিল। শুধু মানুষ নয়, গরু-ছাগল-মহিষ আর মানুষের মৃতদেহে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কোনও রকম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া মানুষ ও পশু মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল সেদিন।

 

উপকূলীয় ছনুয়া এলাকার স্হায়ী বাসিন্দা মুহাম্মদ মুহিবুল্লাহ ছানুবী বলেন, আজ ২৯শে এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এইদিনে আমার বাবা সহ আমাদের পরিবার থেকে ১৫-২০ জন সদস্য শাহাদাত বরন করেন। তাদের সেই দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে ৩৩ বছর ধরে কেঁদে যাচ্ছি। সাগর পানে থাকিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছি। পরিবারের মাত্র তিনজন সদস্যের লাশ পেয়েছিলাম, অন্যান্য সদস্যের লাশ ২৮ বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি। প্রতি বছর ২৯শে এপ্রিল এলেই বাড়ীতে কান্নার রোল পড়ে যায়। কাউকে শান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাইনা। শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হে মহান আল্লাহ তুমি তাদের ধৈর্য শক্তি দাও।

 

পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম পাল বলেন, বাঁশখালী উপকূলের বেড়িবাঁধের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। বেড়ীবাঁধের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে তা আগামী বর্ষার আগে পাবার সম্ভাবনা নেই। আমরা দুর্যোগ মোকাবেলায় সার্বক্ষণিক বাঁশখালীকে নজরে রেখেছি।

 

এদিকে ভয়াল সেই ২৯ এপ্রিল স্মরণে বাঁঁশখালী উপকুলীয় এলাকা খানখানাবাদ, সরল, গন্ডমারা, ছনুয়া ও চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের আলোচনা সভা, সেমিনার,খতমে কোরআন ও দোয়া মাহফিলের আয়োজনের মধ্যামে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।


error: Content is protected !!