ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩রা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩রা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার উল্লাস পাল

ভালোবাসা, সংগ্রাম আর স্বপ্নের আরেক নাম—উল্লাস পাল। জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতাই তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। দৃঢ় মনোবল, আত্মবিশ্বাস আর নিরলস পরিশ্রমে সব বাধা পেরিয়ে আজ তিনি ৪৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

 

উল্লাসের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর গ্রামে। তার বাবা উত্তম কুমার পাল একজন মৃৎশিল্পী এবং মা আন্না রানী পাল গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে উল্লাস বড়। জন্ম থেকেই তার দুই হাত-পা বাঁকা ছিল। হাঁটাচলায় ছিল জটিলতা। শিশুকালে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে না পারলেও বাবা-মায়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। একটি পায়ের অপারেশনের মাধ্যমে কিছুটা হাঁটার সক্ষমতা ফিরে পেলেও তা ছিল ব্যথাদায়ক এবং সীমিত। তবুও থেমে থাকেননি উল্লাস। বরং কষ্টকে রূপান্তর করেছেন শক্তিতে।

১৯৯৯ সালে ভর্তি হন কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্ষাকালে কাদামাটি পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া ছিল কষ্টসাধ্য, বাবাই কোলে করে নিয়ে যেতেন। বাঁ হাতে লিখে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।

 

২০১০ সালে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকায় উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন নর্দান কলেজে এবং ২০১২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়াশোনা করে ২০১৬ সালে বিবিএ ও পরে এমবিএ সম্পন্ন করেন।

 

উল্লাসের স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়া। সে লক্ষ্যে অংশ নেন ৪০তম, ৪১তম এবং ৪৩তম বিসিএসে। ৪০তম বিসিএস পাস করলেও কোনো পদ পাননি। ৪১তম বিসিএসে সুপারিশ পান জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে। ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে নির্বাচিত হয়ে যোগ দেন নড়িয়া সরকারি কলেজে প্রভাষক পদে। তবে তার স্বপ্ন ছিল প্রশাসন ক্যাডার হওয়া, যা বাস্তব হয় ৪৪তম বিসিএসে।

 

এলাকাবাসী মনে করেন, উল্লাস পাল শুধুই একজন বিসিএস ক্যাডার নন, তিনি তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা। প্রতিবেশী রূপক পাল বলেন, “উল্লাস প্রমাণ করেছে প্রতিবন্ধী মানেই বোঝা নয়, বরং সে আজ আমাদের গর্ব।”

 

তার মা আন্না রানী পাল বলেন, “ছেলেটা ছোট থেকেই সংগ্রাম করে বড় হয়েছে। আমরা কষ্ট করে ওকে এগিয়ে এনেছি। আজ সে প্রশাসনে কাজ করবে—এই ভাবনাতেই বুক গর্বে ভরে যায়।”

 

বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন, “ওর পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা দেখেই আমরা সব সময় সাহস দিয়েছি। আজ সেই সাহস ওর জীবনে আলো এনেছে।”

 

নিজের অনুভূতি জানিয়ে উল্লাস পাল বলেন, “যখন নিশ্চিত হলাম আমি প্রশাসন ক্যাডার হয়েছি, তখন চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অনেকেই উপহাস করেছে, বলেছে পারব না—কিন্তু আমি দমে যাইনি। আজ আমার স্বপ্ন পূর্ণতা পেয়েছে।”

 

তিনি আরও বলেন, “সরকার আমাকে যেখানেই দায়িত্ব দিক, আমি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করব। শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা কোনো অভিশাপ নয়। আমি চাই সমাজ যেন করুণা নয়, সম্মানের চোখে আমাদের দেখে।”

 

কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ বলেন, “শারীরিকভাবে কিছু সমস্যা ছিল, কিন্তু মেধা ও মনোবল ছিল অসাধারণ। ওর এই অর্জন সত্যিই গর্বের।”

 

উল্লাস পাল আজ শুধু কার্তিকপুর গ্রামের নয়, গোটা দেশের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত—যে সাহস, অধ্যবসায় ও স্বপ্ন মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তার প্রমাণ।

মোঃ সাইফুল ইসলাম/ শরীয়তপুর


error: Content is protected !!