
জি-২০ সম্মলেনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে ঘিরে তিস্তাপাড়ের মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছে। শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বসবেন বলে জানা গেছে। নির্ধারিত কোনো এজেন্ডা না থাকলেও ওই বৈঠকে নানা দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তির ফয়সালা ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের গুরুত্ব খোলাসা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষ।
বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রংপুর নগরীর সুমি কমিউনিটি সেন্টারে ‘প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর উপলক্ষ্যে তিস্তাপাড়ের মানুষের প্রত্যাশা শীর্ষক’ সংবাদ সম্মেলন এ আহ্বান জানানো হয়। এতে তিস্তা চুক্তি সই ও নিজের টাকায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি তুলে ধরেন ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’ নেতারা।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, আমরা আন্তঃদেশীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা চুক্তি সইসহ অববাহিকাভিত্তিক তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দাবি করছি। একই সঙ্গে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা নদীর মূলপ্রবাহে ব্যাপক খনন, ভাঙন রোধে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন চেয়ে আসছি। এর একটিও বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটার ব্যাপী তিস্তা অববাহিকার ২ কোটি মানুষের জীবনে নেমে এসেছে মহাদুর্যোগ।
তিনি আরও বলেন, খরার চেয়ে ভাঙনে সবচেয়ে বেশি কাহিল তিস্তাপাড়ের মানুষ। ভাঙনে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার সরকারি-বেসরকারি সম্পদ, জমি, ফসল তিস্তা পেটে যাচ্ছে। হুমকিতে পড়েছে গোটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থী উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা। বাড়ছে রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্র্যের হার। বালু ও পলি জমে তিস্তার বুক (মূলপ্রবাহ) সমতলভূমির চেয়েও উঁচু হয়ে গেছে। ২৩৫ বছর বয়সী বাংলাদেশ অংশের তিস্তার পরিচর্যা করা হয়নি, করা হয়নি খনন। একটু পানি বাড়লেই তিস্তা তার বুকে পানি ধরে রাখতে পারে না। পানি দ্রুত নেমে যায় তিস্তা তীরবর্তী গ্রামের দিকে। বাড়ে ভাঙনের তাণ্ডব। ভাঙনে তিস্তা নদীর প্রস্থ কোথাও কোথাও ১০-১২ কিলোমিটার হয়েছে।
নজরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় পরিস্থিতি ক্রামাগত বেসামাল হয়ে উঠছে। তিস্তার শাখা-প্রশাখা ও উপনদীগুলো ভরাট, দখল এবং তিস্তার সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির চাহিদা বেড়েছে। সাগরের লোনা পানি ঢুকে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলায়। সৃষ্টি হচ্ছে মিঠাপানির ভয়াবহ সংকট। কার্বন নিঃসরণ কমাতে যে ঐক্যমত্য হয়েছিল তা থেকে সরে এসেছে আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্ব। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে গোটা দেশে গোটা পৃথিবীতে বাড়ছে খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও দাবানল। তিস্তা অববাহিকায় বাড়ছে বন্যা ও উপর্যুপরি নদী ভাঙন।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বর্তমান সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনার সমীক্ষা শেষ করেছে। প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি বলে অভিযোগ করেন তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি।
পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান বলেন, আমরা মনে করি তিস্তা ইস্যুটি অমীমাংসিতভাবে ঝুলিয়ে রাখার পাত্র নন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের ভারত সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুই দিক থেকেই তিনি তিস্তার বিষয়টি খোলাসা করবেন। তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তির পাশাপাশি নিজের টাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কেন জরুরি, সে বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরবেন।
তিনি বলেন, কোটি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আমরা তিস্তা মহাপরিকল্পা কাজের শুভ উদ্বোধন দেখতে চাই। চাই একনেকে এ কাজের অর্থ বরাদ্দ। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে নদী ভাঙনের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাব সত্য, কিন্তু খরাকালে তিস্তার জীবন বাঁচিয়ে রাখতে চাই তিস্তা চুক্তি সই, চাই অববাহিকাভিত্তিক তিস্তা নদীসহ ৫৪টি নদীর ব্যবস্থাপনা।
শফিয়ার রহমান বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে ৫৪টি অভিন্ন নদী। ওই ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে উত্তরাঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৩৬টি নদী। রংপুর বিভাগে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ১৮টি। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নতুন দুটি খাল খনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে তিস্তা ছাড়াও দুধ কুমার, ধরলাসহ রংপুরের সব আন্তঃসীমান্ত নদী পানিশূন্যতায় বিরাণভূমিতে পরিণত হবে, হবে নদমা। খরাকালে হবে মরুভূমি, বর্ষাকালে নদী তীরবর্তী জনপদে শুরু হবে ভাঙনের তাণ্ডব। লাখো কোটি টাকার সরকারি, বেসরকারি সম্পদ, জমি, ফসল সব কিছুই তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পেটে চলে যাবে। সমস্যা সমাধানে অববাহিকাভিত্তিক নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ভারত-বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে চুক্তি হয়েছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মিললেও যৌথ নদী কমিশন এ ব্যাপারে এখনো কার্যকর সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দৃশ্যমান করা খুবই জরুরি।
সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য সাখাওয়াত হোসেন রাঙা, তানবীর হোসেন আশরাফী, স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য বখতিয়ার হোসেন শিশিরসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আগত নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) নয়াদিল্লি যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ জি-২০ গোষ্ঠীর সদস্য নয়, কিন্তু ভারত জি-২০ গোষ্ঠীর সভাপতিত্ব পাওয়ার পরই মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশকেই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত, যা দুই দেশের সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছানোর দৃষ্টান্ত বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠকে বসবেন বলে আগেই জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।