ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩রা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩রা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আকাশে উড়ে যাওয়া স্বপ্ন আর বিধ্বস্ত বাস্তবতা!

ডেস্ক: মানুষের চিরকালীন স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার। আকাশের অপার নীল দিগন্ত, অনন্ত সূর্যালোক, সাদা মেঘের গালিচা—এসবের টানেই মানুষ শিখেছে পাখির মতো উড়তে। উড়োজাহাজ তাই শুধু এক প্রযুক্তিগত আবিষ্কার নয়, এক দার্শনিক উত্তরণ। এটি মানুষের অদম্য কল্পনা, দূরত্বকে কাছে টেনে আনা, সময়কে জয় করার কৌশল। আর সেই কল্পনারই মূর্ত প্রতীক হলো বিমানের জন্ম, যার ইতিহাস শুরু হয়েছিল ১৯০৩ সালে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রথম সফল নিয়ন্ত্রিত ও শক্তিচালিত উড্ডয়নের মধ্য দিয়ে।

এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার

এরপর সময় যত এগিয়েছে, বিমান হয়ে উঠেছে বাণিজ্য, আবেগ, যুদ্ধ, ভালোবাসা, যাত্রা, নিরাপত্তা, উন্নয়ন—সবকিছুর বাহক। ১৯০৯ সালে জার্মানির DELAG নামের কোম্পানি প্রথম বাণিজ্যিক বিমান সংস্থা হিসেবে যাত্রা করে। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় শুরু হয় প্রথম নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইট। এখন প্রতিদিন গড়ে এক লাখের বেশি উড়োজাহাজ আকাশে উড়ে বেড়ায়। ২০২৩ সালে বিশ্বের আকাশে যাত্রী সংখ্যা ছিল ৪.৫ বিলিয়ন। এ সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি!

রাজস্থানের এক চিকিৎসক দম্পতি—ডা. কৌমি ব্যাস ও ডা. প্রতীক জোশী, এবং তাদের তিন ছোট সন্তান—মিরায়া, প্রদ্যুত ও নকুল। তারা বিমানে ওঠার আগে নিজেদের ছবি তুলেছিলেন। ছবিটিতে ছিল হাসি—যার অর্থ এখন শুধুই বিষাদ।

 

FlightRadar24-এর তথ্য অনুযায়ী ব্যস্ততম সময়ে ১৫,০০০+ বিমান একসাথে আকাশে থাকে। মহাকাশ থেকে দেখলে এই মুহূর্তে পৃথিবীর আকাশে জ্বলজ্বল করতে দেখা যাবে এসব বিমান—যেন এক জটিল তারজালে বোনা মানবসভ্যতার সংযোগ। সিউল-জেজু ও মেলবোর্ন-সিডনি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত রুটের মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের দীর্ঘতম নন-স্টপ ফ্লাইট: Singapore Airlines (নিউয়ার্ক → সিঙ্গাপুর, ১৮ ঘণ্টা ৫০ মিনিট)।

আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনার একমাত্র জীবিত ব্যক্তি—বিশ্বাস কুমার রমেশ।

এই বিশাল এভিয়েশন জগতে কাজ করে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ। বোয়িং, এয়ারবাস, বম্বারডিয়ার, এমব্রায়ার, কম্যাক—এদের হাত ধরেই তৈরি হয় বিশ্বের প্রায় ৫,০০০ এয়ারলাইন্সের বিমান। Airbus বর্তমানে ৫০% বাজার দখল করে আছে আর Boeing ৪৫%, বাকি ৫% অন্যান্যরা। আজকের দিনে এই খাতের বার্ষিক আয় ৮০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

 

 

তবে এই স্বপ্নের আকাশেই কখনো কখনো ছায়া নেমে আসে। আর এমনই এক অন্ধকারময় মুহূর্তে পৃথিবী থমকে দাঁড়ায়—যখন ভেঙে পড়ে একটি উড়োজাহাজ। ১২ জুন ২০২৫, আহমেদাবাদ, ভারত—বিশ্ব ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক দিন।

আহমেদাবাদের বিমান দূর্ঘটনায় যে কানাডিয় নাগরিক মারা গেছেন তাঁর পরিচয় পাওয়া গেছে তিনি হলেন- ড. নিরালি সুরেশকুমার প্যাটেল (Dr. Niralii Sureshkumar Patel)। বয়স ৩৪ বছর। রিজেনারেটিভ ডেন্টিস্ট্রি বিশেষজ্ঞ (Regenerative Dentistry)। তিনি টরন্টোর “স্মাইল রিনিউয়াল ক্লিনিক”-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর স্বামী ড. অর্জুন মেহতা টরন্টো জেনারেল হসপিটাল এর কার্ডিওলজিস্ট। তাঁদের একমাত্র কন্যা আয়রা (৫)।

১২ জুন দুপুর ১:৩৮ মিনিট। লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করছিল এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। যাত্রী ছিলেন ২৩০ জন, সঙ্গে ১০ ক্রু ও ২ জন পাইলট। উড্ডয়নের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয় আহমেদাবাদের একটি আবাসিক এলাকার উপর, যেখানে রয়েছে বি জে মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের হোস্টেল।

 

 

দৃশ্য ছিল যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র—আকাশে আগুনের কুণ্ডলী, ভবনের ভেতর ঢুকে পড়েছে বিমানের লেজ, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ধ্বংসাবশেষ, পোড়া লাশ। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, উড্ডয়নের পরপরই বিমান নিচে নামতে থাকে এবং বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে বিধ্বস্ত হয়। এ পর্যন্ত অন্তত ২৬৫ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কেবল বিমানযাত্রী নয়, হোস্টেলের বহু ছাত্র ও কর্মীও ছিলেন।

নিহত এক বৃটিশ দম্পতি ও তাদের ৪ বছরের কন্যা।

বেঁচে গেছেন মাত্র একজন—বিশ্বাসকুমার রমেশ, ব্রিটিশ নাগরিক, ১১A আসনে বসা ছিলেন। হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “বিমানে বিকট শব্দ, তারপর আর কিছু মনে নেই… চোখ খুলে দেখি চারপাশে মৃতদেহ।” তাঁর ভাই অজয়ও একই ফ্লাইটে ছিলেন, তিনি এখনো নিখোঁজ।

 

যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন- ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, ৭ জন পর্তুগিজ, ১ জন কানাডিয়ান। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি ও গ্লোসেস্টারের দাতব্যকর্মী দম্পতি আকিল নানাবাওয়া ও হান্না ভোরাজি এবং তাদের ৪ বছর বয়সী কন্যা সারা।

 

 

চিকিৎসা ও উদ্ধার পরিস্থিতি:

৫০-৬০ জন মেডিকেল ছাত্র আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, ৫ জন নিখোঁজ, দুজন আইসিইউতে। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া অনেক মরদেহ শনাক্ত সম্ভব হচ্ছে না। উদ্ধারকাজে অংশ নিচ্ছে ফায়ার সার্ভিস, এনডিআরএফ, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ। ধ্বংসস্তূপ থেকে বিমান ইঞ্জিন, যাত্রীদের লাগেজ, খাবারের ট্রে—সবকিছুই উদ্ধার করা হয়েছে।

 

 

দুর্ঘটনার কারণ কী ছিল এখনো নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সম্ভাবনার কথা বলছেন, ডাবল ইঞ্জিন ফেইলিউর, বার্ড স্ট্রাইক, ফ্ল্যাপ না খোলা (ফ্ল্যাপ রিট্রাক্টেড ছিল) বিমানটির ব্ল্যাকবক্স ইতিমধ্যে উদ্ধার হয়েছে। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয় দেশের তদন্তকারী দল কাজ শুরু করেছে।

 

 

বোয়িং সিইও কেলি অর্টবার্গ বলেছেন- “আমরা এয়ার ইন্ডিয়াকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। ”টাটা গ্রুপ নিহত পরিবারকে ১ কোটি রুপি করে ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহন এবং হোস্টেল পুনর্নির্মাণে সাহায্য করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন “ভারত শক্তিশালী দেশ, প্রয়োজনে আমরা পাশে থাকব।”

 

 

উল্লেখ্য, বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার প্রথম চালু হয় ২০১১ সালে। এটি কার্বন ফাইবার বডি ও উন্নত ফুয়েল ইফিশিয়েন্সির জন্য পরিচিত। এটি ছিল এই মডেলের প্রথম মারাত্মক দুর্ঘটনা। বোয়িং ও GE Aerospace এর সহায়তায় তদন্ত চলছে। মার্কিন পরিবহন সচিব শন ডাফি বলেছেন, এখন পর্যন্ত ৭৮৭ মডেলকে গ্রাউন্ড করার কোনও প্রয়োজন নেই। “আমরা শুধু ভিডিও দেখে সিদ্ধান্ত নেব না, বরং তথ্য যাচাই করে ব্যবস্থা নেব,”—বলেছেন তিনি।

 

 

প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও নিরাপত্তার অগ্রগতির পরও উড়োজাহাজ কখনো কখনো ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। প্রতিটি দুর্ঘটনা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং মানবিক ট্র্যাজেডিও—যেখানে মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে যায় শত শত স্বপ্ন। ইতিহাসে এমন বহু দুঃখজনক অধ্যায় রয়েছে যা আজও এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় সতর্কবার্তা হয়ে আছে। ১৯০৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৫,০০০টির বেশি বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় ২,০০,০০০ মানুষ মারা গেছেন।সবচেয়ে ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটে স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে (Canary Islands) অবস্থিত টেনেরিফ বিমানবন্দরে (১৯৭৭)। KLM বোয়িং ৭৪৭ এবং Pan Am বোয়িং ৭৪৭-এর মুখোমুখি এ সংঘর্ষটি ঘটে রানওয়েতে।যোগাযোগের এক ক্ষুদ্র ভুলে মৃত্যু হয়েছিল ৫৮৩ মানুষের। সাম্প্রতিক বড় দুর্ঘটনা ঘটে নেপালে। ইয়েতি এয়ারলাইন্স (২০২৩) এর এ দুর্ঘটনায় ৭২ জন নিহতহন।

 

উপসংহার:

আকাশকে জয় করার যে স্বপ্নে মানুষ উঠেছিল ডানায় ভর করে, সেই আকাশই মাঝেমধ্যে বিষাদ ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীতে। আহমেদাবাদের এই দুর্ঘটনা কেবল একটি দেশের নয়, পুরো মানবজাতির জন্য এক গভীর শোকবার্তা। প্রতিদিন যখন আমরা যন্ত্রের ডানায় ভর করে মহাদেশ পার হই, তখন এই ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দেয়—প্রযুক্তি যতই অগ্রসর হোক, জীবন এখনো অনিশ্চয়তারই নাম। সেই অনিশ্চয়তাকে মাথায় রেখেই আমাদের এগোতে হয়, প্রতিটি যাত্রার প্রারম্ভে প্রার্থনা করতে হয়—এই যাত্রা যেন নিরাপদ হয়।


error: Content is protected !!